তাবিজ ব্যবহারের হুকুম

প্রশ্ন: তাবিজ ব্যবহারের হুকুম কী? যদি জায়েজ হয়, তাহলে ওই হাদিসের ব্যাখ্যা কী হবে, যাতে বলা হয়েছে, “যে ব্যক্তি তাবিজ ঝুলালো, সে শিরক করল”?

উত্তর: কিছু শর্ত সাপেক্ষে তাবীজ ব্যবহার করা জায়েয আছে। সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা.কর্তৃক বাচ্চাদের গলায় তাবীজ লটকিয়ে দেয়ার ঘটনা এর বৈধতার প্রমাণ বহন করে। আবু দাউদ শরীফের এক বর্ণনায় এসেছে,
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পেরেশানীর সময় বলার জন্য এই শব্দগুলো (দুয়া) সাহাবীদের শিখাতেনঃ ﺃﻋﻮﺫ ﺑﻜﻠﻤﺎﺕ ﺍﻟﻠﻪ ﺍﻟﺘﺎﻣﺔ، ﻣﻦ ﻏﻀﺒﻪ ﻭﺷﺮ ﻋﺒﺎﺩﻩ، ﻭﻣﻦ ﻫﻤﺰﺍﺕ ﺍﻟﺸﻴﺎﻃﻴﻦ ﻭﺃﻥ ﻳﺤﻀﺮﻭﻥ । হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রাযি.তার বুঝমান মেয়েদের এই দুয়া শিখাতেন আর অবুঝ বাচ্চাদের গলায় লিখে ঝুলিয়ে দিতেন।(আবু দাউদ শরীফ ২/৫৪৩)
মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবাতেও অনুরূপ বর্ণনা এসেছে,
……হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রাযি.তার সন্তানদের মাঝে যারা বুঝমান ছিল তাদের এই দুয়া শিখাতেন আর যারা অবুঝ বাচ্চা ছিল তাদের গলায় লিখে ঝুলিয়ে দিতেন।
তাবেঈনের মাঝেও অনেকের থেকে তাবীজ লিখে দেয়ার কথা এসেছে, মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবাতে হযরত মুজাহিদ, মুহাম্মদ ইবনে সিরীন, উবায়দুল্লাহ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে উমর ও জাহ্হাক রহ. প্রমুখ কর্তৃক অন্যদের তাবীজ লিখে দেয়ার কথা, তাবিজ হাতে বা গলায় বাঁধা ও তাবীজ লেখা বৈধ হওয়ার মর্মে তাদের মন্তব্য বর্ণিত হয়েছে।(মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা,হাদীস নং ২৩৪৫, ২৩৪৪৮, ২৩৪৪৯, ২৩৫০, ২৩৫১)
ইবনে তাইমিয়া রহ.ও এর বৈধতের পক্ষে বলেছেন,
বিপদগ্রস্থ,অসুস্থ ও এধরণের লোকদের জন্য কালী দ্বারা আল্লাহর কিতাব বা আল্লাহর যিকির থেকে কিছু লিখে দেয়া,গোসল করানো ও পান করানো জায়েয আছে।
তবে উলামায়ে কেরাম তাবীজ ও ঝাড় ফুক বৈধতা হবার যে সকল শর্তারোপ করেছেন তা হল,
১)এতে শিরকপূর্ণ কোন কথা থাকতে পারবে না। বরং কুরআনের আয়াত,আল্লাহর নাম ও সিফাত বা দুয়ায়ে মাসূরা এ জাতীয় অর্থবোধক কোন কিছু লিখা থাকতে হবে।) মাউসূআতুল ফিকহিয়্যাহ কুয়েতিয়া, ১৩/২৫)
{ ﻭَﻧُﻨَﺰِّﻝُ ﻣِﻦَ ﺍﻟْﻘُﺮْﺁﻥِ ﻣَﺎ ﻫُﻮَ ﺷِﻔَﺎﺀٌ ﻭَﺭَﺣْﻤَﺔٌ ﻟِﻠْﻤُﺆْﻣِﻨِﻴﻦَ { ‏[ ﺍﻹﺳﺮﺍﺀ : 82]
আমি কোরআনে এমন বিষয় নাযিল করি যা রোগের সুচিকিৎসা এবং মুমিনের জন্য রহমত।(সূরা বনী ইসরাঈলঃ৮২)
২) অবোধগম্য কোন কথা না হতে হবে।( মাউসূআতুল ফিকহিয়্যাহ কুয়েতিয়া,১৩/২৪, ফাতাওয়া শামী, ৫/২৩২, উমদাতুল কারী ৫/৩৫২)
উল্লেখ্য, নকশার মাধ্যমে ( ﺍﺑﺠﺪ) তাবীজ জায়েজ। কেননা এটাও বোধগম্য ভাষা।( আহসানুল ফাতাওয়া ৮/২৫৬)
৩)আরবী ছাড়া অন্য কোন ভাষা না হওয়া।
৪)অন্যান্য চিকিৎসা পদ্ধতির মত তাবিজকেও একটি ঔষধ মনে করতে হবে। তাবীজের নিজস্ব প্রভাব ﻣﺆﺛﺮ ﺑﺎﻟﺬﺍﺕ ) ( আছে এরূপ বিশ্বাসে তাবীজ ব্যবহার করা যাবে না। শুধু তাবীজই নয় বরং অন্যান্য ঔষধকেও আরোগ্য দানকারী মনে করে চিকিৎসা নেয়া বৈধ নয়। বরং আল্লাহ তাআলাই আরোগ্য দানকারী,এগুলো উসিলা বা মাধ্যম মাত্র। কুরআনে এসেছে।
{ ﻭَﺇِﺫَﺍ ﻣَﺮِﺿْﺖُ ﻓَﻬُﻮَ ﻳَﺸْﻔِﻴﻦِ { ‏[ ﺍﻟﺸﻌﺮﺍﺀ : 80 ]
যখন আমি রোগাক্রান্ত হই,তখন তিনিই(আল্লাহ তাআলা) আরোগ্য দান করেন। (সূরা আশ-শো’আরাঃ ৮০)
“যে ব্যক্তি তাবীয ঝুলালো সে শিরক করল”। হাদীসের ব্যাখ্যা
শুরুতেই ঐ সকল হাদীস দেখেনেই যাতে তাবীজকে শিরক বলা হয়েছে,
( ﻣﻦ ﻋﻠﻖ ﺗﻤﻴﻤﺔ ﻓﻘﺪ ﺃﺷﺮﻙ ‏( ﺭﻭﺍﻩ ﺃﺣﻤﺪ
যে তাবীজ লটকালো,সে শিরক করল। (মুসনাদে আহমদ)
অবশ্যই ঝাড়-ফুক, তাবীজ ও যাদু শিরক।( মুসতাদরাকে হাকেম)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর দরবারে একদল লোক উপস্থিত হল। অতঃপর তিনি নয় জনকে বাইয়াত করালেন আর একজনকে বাইয়াত করালেন না। তারা বলল,ইয়া রাসূলুল্লাহ! নয় জনকে বাইয়াত করলেন আর একজনকে বাদ রাখলেন? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন,তার সাথে একটি তাবীজ রয়েছে। তখন তার হাত ভিতরে ঢুকালেন ও সেটা ছিড়ে ফেললেন। অতপর তাকেও বাইয়াত করালেন এবং বললেন, যে যে তাবীজ লটকালো,সে শিরক করল।(মুসনাদে আহমদ)
এবার জবাবে আসা যাক!এখানে প্রথম হাদীস দুটিতে যে তাবিজের কথা বলা হয়েছে,তার দ্বারা শিরকপূর্ণ তাবীজ উদ্দেশ্য। তার প্রমাণ হলো দ্বিতীয় হাদীসে ঝাড়-ফুককেও শিরক বলা হয়েছে,অথচ সব ঝাড়-ফুক শিরক নয়; রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে ঝাড়-ফুক করেছেন ও কখনো সাহাবাদেরও করতে বলেছেন,
আম্মাজান আয়েশা রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঝাড়-ফুক করতেন, আর এ দু’আ পাঠ করতেনঃ ﺍﻣﺴﺢ ﺍﻟﺒﺎﺱ ﺭﺏ ﺍﻟﻨﺎﺱ ﺑﻴﺪﻙ ﺍﻟﺸﻔﺎﺀ ﻻ ﻛﺎﺷﻒ ﻟﻪ ﺇﻻ ﺃﻧﺖ ।(সহীহ বুখারী ২/৮৫৫)
আম্মাজান আয়েশা রা. হতে বর্ণিত,তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে বদনযর থেকে বাচতে ঝাড়-ফুকের নির্দেশ দিতেন। (সহীহ মুসলিম,২/২২৩)
অতএব এখানে ঝাড়-ফুককের ক্ষেত্রে যে ব্যাখ্যা দেয়া হবে তাবীজের ক্ষেত্রেও একই ব্যাখ্যা করা হবে। বিশেষতঃ এর ব্যাখ্যা দিতে আমরা সকলেই বাধ্য,কেননা সহীহ হাদীস দ্বারা সাহাবা ও তাবেঈনগন কর্তৃক ঝাড়-ফুকের মত তাবীজ ব্যবহারেরও প্রমাণ পাওয়া যায়; যা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁরা যেই ঝাড়-ফুক বা তাবীজ ব্যবহার করেছেন তা শিরকপূর্ণ ছিলনা,শিরকপূর্ণ হলে তাঁরা তা করতেনও না। সুতরাং একথা স্পষ্ট হয়ে গেল,হাদীসে যে তাবীজ ব্যবহার নিষিদ্ধ বলা হয়েছে তা শিরকপূর্ণ। আর আমরা তো আগেই বলেছি, শিরকপূর্ণ তাবীজ ব্যবহার বৈধ নেই।
তৃতীয় হাদীসে তাবীজ থাকার কারণে এক ব্যক্তির বাইয়াত না নেয়া ও তার তাবীজ খুলে ফেলার কথা বর্ণিত হয়েছে। এ দ্বারা কোন ভাবেই সব রকম তাবীজ নিষিদ্ধ হওয়ার দলীল দেয়া যায় না। কারণ,সে লোকটা ইসলাম গ্রহণের জন্য এসেছিল। মুসলমান হবার পূর্বে সে যে তাবীজ লাগিয়ে ছিল তা শিরকপূর্ণ তাবীজ হওয়াই স্বাভাবিক। সুতরাং তার তাবীজটির প্রতি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আপত্তি করাটাই যুক্তিসঙ্গত।

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় ফতোয়াসমূহ

গর্ভপাতের পর নামাজ

মুসাফির অবস্থায় জামাতে নামাজ এবং রাকাত সংখ্যা

দোয়া কুনুত না পড়ে রুকুতে চলে গেলে কী করবে?

কবর খননের সুন্নত পদ্ধতি

তাহাজ্জুদ, আউয়াবিন ও অন্যান্য নফল নামাজ জামাতে পড়ার বিধান